আমি নিজেকে যে কয়েকটি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাবি করতে পারি তার একটি হচ্ছে- ‘বাংলাদেশের সড়ক পথের নিরলস যাত্রী’। শুধু যে মুখের কথায় দাবি করছি তা নয় আমি তার প্রমাণও দিতে পারব। যে দুমড়ানো-মোচড়ানো মাইক্রোবাসটিতে আমি সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছি (এবং আলাদাভাবে ঢাকা-সিলেট কিংবা সিলেট-ঢাকা করেছি)- তার কারণে যে দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়েছে সেটি যদি শুধু একদিকে করা হতো তাহলে এর মাঝে পুরো পৃথিবীটাকে কমপক্ষে ছয়বার পাক খেয়ে আসতাম! কাজেই সড়ক পথে চলাচলের যে সব আনন্দ, বেদনা কিংবা আতঙ্কের অভিজ্ঞতা হওয়া সম্ভব আমার সবগুলো হয়েছে।
যখন মেঘনা ব্রিজ তৈরি হয়নি তখন ফেরি পার হওয়ার জন্য অনেক রাত রাস্তায় কাটিয়েছি। জামায়াত-শিবিরের চোখকে ফাঁকি দেয়ার জন্য ঘরের বাতি না জ্বালিয়ে অন্ধকারে প্রস্তুতি নিয়ে গভীর রাতে ঢাকা রওনা দিয়েছি। ছাত্রলীগের ছেলেদের মাস্তানি করার অপরাধে শাস্তি দেয়ার কারণে, তারা আমাদের রাস্তায় খুঁজে বেড়াচ্ছে তার অভিজ্ঞতাও আছে। দিন দুপুরে পেছন থেকে বাস ধাক্কা দিয়েছে, কুয়াশায় সামনে থেকে কিংবা পাশ দিয়ে চলতে থাকা ট্রাকের টায়ার ফেটে তার শক্তিশালী ঝাপটায় পাশ থেকে গাড়ির দরজা-জানালা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে।
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে বাংলাদেশের সড়ক পথের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? আমি এককথায় সেটা বলে দিতে পারব সেটা হচ্ছে বেপরোয়া ড্রাইভিং। এই দেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী কিংবা বড় বড় কর্মকর্তারা কোনোদিন সেটা সম্পর্কে বলতে পারবেন না। কারণ তাদের কখনো সেটা দেখতে হয় না। বেপরোয়া ড্রাইভিং যে কী পরিমাণ বেপরোয়া সেটি শুধু আমাদের মতো সড়ক পথের সাধারণ যাত্রীরা জানে।
২.
বেশ কিছুদিন আগের কথা, আমি বাসে করে ঢাকায় যাচ্ছি। আমার সিট ঠিক ড্রাইভারের পেছনে। ড্রাইভার কীভাবে গাড়ি চালাচ্ছে সেটা আমি দেখতে পাচ্ছি। বিশাল একটা বাস সরু একটা রাস্তায় গুলির মতো ছুটে যাচ্ছে। অনেক বড় এবং দামি বাস। শুনেছি ড্রাইভারদের এই বাস চালানোর জন্য বিদেশ থেকে ট্রেনিং দিয়ে আনা হয়েছে। আরও শুনেছি এই বাস ড্রাইভারের বেতন আমাদের বেতন থেকেও বেশি। এটা অবশ্য যাচাই করে দেখার কোনো সুযোগ পাইনি! এ রকম দামি বাস ঠিকভাবে চালালে বাসটি আসলেই চলছে নাকি দাঁড়িয়ে আছে সেটাও বোঝার কথা নয়- দেশের বাইরে বাস চড়ায়, অভিজ্ঞতা থেকে আমি সেটা জানি। কিন্তু এই বাসটি এমনভাবে চলছে যে আমরা যাত্রীরা বাসের ভেতর একবার ডানদিকে একবার বামদিকে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছি। আমি বিস্ফোরিত চোখে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ দেখলাম আমাদের বাসটি অন্য কোনো একটি বাস, ট্রাক কিংবা গাড়িকে ওভারটেক করার জন্য রাস্তার ডানপাশে চলে এসেছে। এটি নতুন কিছু নয়, সবসময় এটি হয়। সব বাস-ট্রাক গাড়ি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে নিজের লেন থেকে অন্যের লেনে চলে আসে। আমি হঠাৎ দেখলাম সামনে একটি রিকশা। মহাসড়কে সম্ভবত রিকশা থাকার কথা নয়, কিন্তু দেশে কে আর এই নিয়ম মানে? একটা রিকশা আর কতটুকু জায়গা নেয়? সহজেই তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু আমি হঠাৎ লক্ষ করলাম আমাদের বাসের ড্রাইভার অবিশ্বাস্য নৃশংসতায় সোজাসুজি সেই রিকশাটিকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করল! আমি আতঙ্কে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করলাম এবং যখন চোখ খুলেছি তখন টের পেয়েছি একেবারে শেষ মুহূর্তে রিকশাটি রাস্তা থেকে নিচে সরে গিয়ে তার প্রাণরক্ষা করেছে। আমার কিছুক্ষণ লাগল ধাতস্থ হতে, যখন ধাতস্থ হয়েছি তখন ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা আপনি কী করেছেন? রিকশাটিকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন?” ড্রাইভার আমার দিকে তাকাল কোনো কথা বলল না, তারপর তার হেল্পারকে বলল আমার সামনের পর্দাটা টেনে দিতে। আমি যেন তার ড্রাইভিং আর দেখতে না পারি।
ড্রাইভিং এবং সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে নতুন আইন হয়েছে এবং সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনা সম্পর্কে পড়তে এবং জানতে আমি আগ্রহ পাচ্ছি না। যে দেশে ড্রাইভাররা মনে করে যেহেতু আমার গাড়ি সাইজে বড়, দাম বেশি, তাই রাস্তায় আমার অধিকার বেশি, আমি মানুষজনকে পিষে মেরে ফেলার চেষ্টা করব, যার বেঁচে থাকার ইচ্ছা যে যেভাবে পারে বেঁচে থাকার চেষ্টা করুক। সেই দেশে ড্রাইভিং সংক্রান্ত আইন-কানুন নিয়ে আলাপ-আলোচনার কোনো অর্থ আছে কিনা, আমি জানি না।
প্রথমে সবাইকে বিশ্বাস করতে হবে মানুষের প্রাণ সবচাইতে মূল্যবান, কোনোভাবে কখনো কারও প্রাণের ঝুঁকি নেয়া যাবে না। সে জন্য আমার যত অসুবিধা হোক সেই অসুবিধা আমাকে মেনে নিতে হবে। যে দেশে প্রাণের মূল্য নেই সেই দেশের আইনের কী মূল্য আছে?
৩.
বেশ কয়েক বছর আগে আমি অফিসে বসে আছি হঠাৎ আমার এককালীন ছাত্র এবং বর্তমান সহকর্মীর কাছ থেকে ফোন এসেছে। ফোনটি ধরতেই তার গলায় হাহাকারের মতো আর্তনাদ শুনতে পেলাম। এইমাত্র তার বাস আরেকটা বাসের সঙ্গে মুখোমুখি অ্যাকসিডেন্ট করেছে, তার চারপাশে মৃতদেহ এবং মৃতদেহ (যতদূর মনে আছে সব মিলিয়ে ১৬ জন মারা গিয়েছিল)। নিজের দেশটাকে নিয়ে যতই হা-হুতাশ করি না কেন, আমাদের এই সাদামাটা দেশটার জন্য গভীর একটা ভালোবাসা আছে, কারণ এই দেশে ভয়ংকর বিপদের সময় খুবই সাধারণ মানুষ সাহায্য করার জন্য ছুটে আসে। এবারও তাই হয়েছে। একজন রিকশাওয়ালা জানালা দিয়ে ঢুকে আমার আহত তরুণ সহকর্মীকে বের করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ফিরে এসে আরেকজনকে, তারপর আরেকজনকে, এভাবে যতজনকে সম্ভব সে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। আমার তরুণ সহকর্মীকে সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং সে শেষ পর্যন্ত বেঁচে গিয়েছিল।
আমার সহকর্মী সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আমি তাকে বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করতে রাজি করিয়েছিলাম। এই দুর্ঘটনাগুলো আসলে মোটেও দুর্ঘটনা নয়- এগুলো হচ্ছে বাস কোম্পানির অবহেলা এবং ড্রাইভারদের বেপরোয়া ড্রাইভিং। আমি ভেবেছিলাম যদি কোনোদিন কোনোভাবে একটা বাস কোম্পানিকে অভিযুক্ত করিয়ে তাদের কাছে থেকে অনেক বড় ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়, তাহলে দেশের সব বাস মালিক সাবধান হয়ে যাবে। মানুষের প্রাণরক্ষার জন্য না হলেও শুধুমাত্র গাঁটের পয়সা থেকে বড় জরিমানা দেয়ার ভয়ে তারা হয়তো একটু সাবধানে বাস চালাবে।
দীর্ঘদিন মামলা চলেছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। একটা দুর্ঘটনার পরপর বিআরটিএ থেকে একটা রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হয়। এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বিআরটিএ কখনোই বাস কোম্পানির বিপক্ষে কিছু লেখে না এবং তার কারণটি বুঝতে আমাদের রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হবে না।
আমার বিশ্বাস দেশে যদি দুর্ঘটনার পর দোষী ড্রাইভার কিংবা বাস কোম্পানিগুলোকে আহত-নিহতদের বড় ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা যায়, শুধুমাত্র তাহলেই এই অশুভচক্র একটুখানি সতর্ক হবে। মানুষের প্রাণকে একটুখানি মূল্য দেবে। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৯, পাস করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সারাদেশে একটি বিচিত্র নাটক অভিনয় হতে দেখলাম। সারাদেশে ঘোষিত এবং অঘোষিত বাস-ট্রাক ধর্মঘট। দেশের সব মানুষ রাতারাতি পরিবহন শ্রমিকদের হাতে পুরোপুরি জিম্মি হয়ে গেল। সারা পৃথিবীর কোথাও এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের দেশে এটি ঘটে এবং আমরা আজকাল মোটামুটি এতে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছি। আমরা মেনে নিয়েছি বাস মালিক এবং পরিবহন শ্রমিকরা যখন খুশি যেভাবে খুশি আমাদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দেবে, আমাদের সেটা মেনে নিতে হবে।
অথচ এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশ ছোট্ট একটুখানি দেশ, এই দেশটি ট্রেনলাইন দিয়ে আষ্টে-পৃষ্টে বেঁধে ফেলা সম্ভব। আমি সড়ক পথে যাতায়াত সংক্রান্ত একজন ‘বিশেষজ্ঞ’, আমি জোরগলায় ঘোষণা দিতে পারি এই দেশে সড়কপথে যাতায়াত যে রকম একটি বিভীষিকা ট্রেনপথে যাতায়াত ঠিক সে রকম একটি আশীর্বাদ। আমাদের পাশের দেশ ভারতবর্ষেও অসাধারণ ট্রেন যোগাযোগ গড়ে তোলা হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে সেটি গড়ে ওঠেনি। কেন গড়ে ওঠেনি কিংবা কেন গড়ে উঠছে না? এমন তো না যে এখন আমাদের দেশের টাকা-পয়সার টানাটানি। আমরা তো প্রায় নিয়মিতভাবে নতুন নতুন মেগা, সুপার মেগা প্রকল্পের খবর পড়ছি। তাহলে কেন সারাদেশে নতুন নতুন রেললাইন বসানো হচ্ছে না? কেন সেই লাইনগুলো দিয়ে প্রতি পাঁচ মিনিটে একটার পর আরেকটা ট্রেন যাচ্ছে না? কেউ কি কখনো ঢাকা-সিলেট কিংবা চট্টগ্রাম-সিলেট ট্রেনে গেছে? সেই ট্রেনগুলোর কী ভয়াবহ অবস্থা কেউ কি জানে? আমরা কি একটুখানি নিরাপদ ট্রেনের আশা করতে পারি না? তাহলে কেন এত বছর পরও দেশে আধুনিক একটা ট্রেনের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠল না?
আমি এর দুটি ব্যাখ্যা শুনেছি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষরা তার সত্যতা নিয়ে কথা বলতে পারবেন। প্রথম ব্যাখ্যাটি এ রকম: বাংলাদেশে পৃথিবীর যাবতীয় বাস, গাড়ি, ট্রাক যেন বিক্রি করা যায় সে জন্য এখানে রাস্তাঘাট তৈরি করার জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টাকা-পয়সা ঋণ দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ট্রেন যোগাযোগকে নিরুৎসাহিত করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি এ রকম: এই দেশে বাস মালিকরা অসম্ভব ক্ষমতাশালী মানুষ, তাদের বাসের ব্যবসা যেন ঠিকভাবে চলে সে জন্য তারা কখনো এই দেশে ট্রেন যোগাযোগ গড়ে তুলতে দেবে না।
যদি সত্যি সত্যি আমাদের দেশে ট্রেনের চমৎকার একটা নেটওয়ার্ক থাকত আমরা সবাই যদি ট্রেনে যখন খুশি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারতাম, তাহলে কি এই দেশের বাস মালিক আর শ্রমিকরা এ রকম হুট করে ধর্মঘট ডেকে পুরো দেশ অচল করে দিতে পারত?
সত্যি যদি কথায় কথায় ধর্মঘট ডেকে বসত, আমরা কি তখন তাদের থোড়াই কেয়ার করতাম! কেন আমাদের নিজের দেশে অন্যদের জিম্মি হয়ে থাকতে হবে?
লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ড. রকিবুল হাসান: রবীন্দ -নজরুলের পরে এখনও জসীম উদ্দীনের নামই অবধারিতভাবে চলে আসে। এই ক্রমধারা থেকেই অনুধাবন করা যায় বাংলা কবিতায় জসীম উদ্দীনের অবদান ও অবস্থান। পল্লীকেন্দ্রিক যাপিতজীবন ও প্রকৃতিকে কবিতায় উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে জসীম উদ্দীনের পূর্বসূরি রয়েছেন আরও অনেকেই। তিনি নিজস্ব প্রতিভাবৈচিত্র্য ও সক্রিয়তায় পল্লী কবিতার এ ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন বহুগুণে।
প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর :২৬ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
করুণানিধানের এ ধারা বা ভাবনাটি আরও অনেকখানি এগিয়ে নেন যতীন্দ মোহন বাগচী। পল্লীর দৈনন্দিন জীবনযাপন তাকে অনেকটা গভীরভাবেই স্পর্শ করে। যে কারণে যতীন্দ মোহন রবীন্দ ভাবনায় লালিত হয়েও তার কাব্যে পল্লীজীবন বৈচিত্র্যকে কাব্যে উপজীব্য করেছেন। যতীন্দ মোহনের কবিতায় পল্লীর বহুমাত্রিকতা সন্নিবদ্ধ না থাকলেও, পল্লী-প্রকৃতিকে কবিতায় পরীক্ষা-নীরিক্ষার প্রয়াস লক্ষ করা না গেলেও, তার কবিতায় পল্লীর নিবিড় ও সৌম্য-শান্ত যে রূপটি ধরা পড়েছে তা কাব্যের এ নবধারায় গুরুত্বপূর্ণ।
এ নদীর কথা তার কবিতায় বহুভাবে বহু রঙে ব্যঞ্জিত হয়েছে। এ নদীর সঙ্গে তার জন্মান্তরের সৌহার্দ্য- কবি তা নিজেই স্বীকার করেছেন। পল্লীর মাঠ-ঘাট, বনস্পতি ফল, ছায়াতরু, তৃণগুল্ম, মেঘলা আকাশ, ভোরের আকাশ, গ্রামের পাখি, হাওর-বিল-নদী-নালা পরম মমতায় তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন।
পল্লী যেন নিজস্ব স্বরূপে এই প্রথম কবিতারাজ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ এক রূপে সেও যে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতে পারে- কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কবিতায় সেই সত্য বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
চূড়ান্ত সিদ্ধি অর্জনে তিনি সক্ষম না হলেও এ ধারাকে সমৃদ্ধতর করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অসামান্য ছিল। এ ধারারই সবচেয়ে সফল কবিপুরুষ জসীম উদ্দীন। পল্লী-প্রকৃতি আর যাপিতজীবনকে তিনি ভোরের ঘাসে শিশির ফোটার মতো কবিতায় অসামান্য দক্ষতায় ‘টলমল’ জীবন্ত করে তুললেন।
এতদিনে করুণানিধান, যতীন্দ্রমোহন ও কুমুদরঞ্জনেরা পল্লী-প্রকৃতিকে কবিতায় উপজীব্য করে যে নবধারার যাত্রা রচনা করেছিলেন, জসীম উদ্দীনের হাতে পেল তার উজ্জ্বল পূর্ণতা। জসীম উদ্দীনের সমকালীন সময়ে বন্দে আলী মিয়া ও কাজী কাদের নওয়াজ পল্লী জীবনপ্রকৃতি নিয়ে কাব্যচর্চায় সফলতা লাভ করলেও জসীম উদ্দীন হয়ে ওঠেন সমকালীন কবিদের মধ্যমণি। পাঠকমহলে লাভ করেন অবিশ্বাস্যরকমের জনপ্রিয়তা।
সমকালীন কবিদের মধ্যে নজরুলের পরে আর কেউই জসীম উদ্দীনের মতো জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেননি। এমনকি পরবর্তীতেও আর কোনো কবি তার জনপ্রিয়তাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হননি। জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় বিখ্যাত কবি। পল্লী-প্রকৃতির রূপমাধুর্য তিনি অসাধারণ শিল্পশৈলীতে তুলে ধরে বাংলা কবিতায় অসম্ভবরকম জনপ্রিয়তা লাভা করেছেন।
তারপরও জসীম উদ্দীন যেভাবে ঘাট-মাঠের মানুষের কবি, জীবনানন্দ দাশ সেখান থেকে খানিকটা দূরেই। জীবনানন্দ দাশ যতখানি পল্লী-প্রকৃতির কবি, পল্লীর মানুষের ততখানি নন। পল্লী-নগরসভ্যতা-ইতিহাস-ঐতিহ্য সবমিলে জীবনানন্দের জগৎ ভিন্ন।
জসীম উদ্দীনের পরেও আর একজন বাঙালি কবি পল্লী-প্রকৃতি ও পল্লীর মানুষকে নিয়েই জীবনভর কবিতা লিখেছেন, তিনি ওমর আলী। একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কবি হলেও, ব্যাপক জনপ্রিয়- সে অভিধা তিনি লাভ করতে পারেননি।
জসীম উদ্দীনের এ রকম জনপ্রিয়তা লাভের মূল কারণ কী ছিল- সে বিষয় ভাবা যেতেই পারে। পল্লীর সহজ-সরল জীবনগাথাই তার কাব্যে পাঠকপ্রিয়তা লাভে মূল কারণ- এ প্রশ্নও খুব স্বাভাবিক। পল্লীর এ সহজ-সরল জীবনগাথা তো অন্য কবিরাও তাদের কাব্যে উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে ছিলেন। কিন্তু তারা জসীম উদ্দীনের মতো কবিখ্যাতি ও পাঠকপ্রিয়তা লাভে সক্ষম হননি।
তিনি পল্লীর জীবনগাথাকে যেভাবে জীবন্ত করে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, সমাজচিত্রকে যে নিপুণতায় এঁকেছেন, গ্রামীণ মানুষের মনস্বত্বঃ যেভাবে তিনি ধরেছেন, তাদের মানবসম্পর্ক ও প্রেমকে যে ট্রাজিক রূপদান করেছেন, সর্বোপরি সামগ্রিক বিষয়কে শিল্পগুণ সমৃদ্ধ করে অসাধারণ ভাষাভঙ্গিমায় কাব্যরূপ দান করেছেন- তা পাঠকপ্রিয়তা লাভে বড় শক্তি।
নজরুল পরাধীন দেশের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে অগ্নিবীণা বাজিয়েছিলেন, বিষের বাঁশিতে সর্বনাশার সুর জাগরিত করেছিলেন, মহাসমুদ্রের তুফান কবিতায় এনেছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মহামন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, এ সব তাঁর আকাশ-স্পর্শী জনপ্রিয়তা অর্জনের মূল কারণ। জসীম উদ্দীন নজরুলের এ ধারায় একটুও না গিয়ে পল্লীর সাধারণ মানুষের আনন্দ-বেদনাকে কাব্যে ধারণ করে পাঠকের হৃদয় জয় করেন। তাঁর কবিতার করুণ রস বা ট্রাজেডিই পাঠকপ্রিয়তা লাভে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে -এমন বিবেচনা নানাকৌণিক থেকেই নির্ণীত হতে পারে।
জসীম উদ্দীনের কাহিনী কাব্য চারটি : ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘সকিনা, ও ‘মা যে জননী কান্দে’। এ চারটি কাব্যেই ট্রাজেডি রস সঞ্চারে কবি সফলতার পরিচয় রেখেছেন।
‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্য দুটিতে শেকসপিরিয়ান ট্রাজেডি রূপবৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে। কর্মের ফলই যে মানুষ ভোগ করে এ দুটো কাব্যে শেকসপীয়রের নাটকের ট্রাজেডির মতোই একই সত্যরূপ লক্ষণীয়। এখানে আলোচনা ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ দেখা যায়, কাব্যে রূপাই ও সাজু বিয়ে করে সুখের সংসার বেঁধেছিল।
বন গেঁয়োরা যখন গাজনা চরের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছিল, সে খবর পেয়েই রূপাই সড়কি-ঢাল নিয়ে গাজনাচরে কাইজা করার জন্য ছুটে যায় এবং নেতৃত্ব দেয়। রূপাই ইচ্ছে করলে এই কাইজা সে এড়াতে পারত। কিন্তু কাইজা শেষে যখন সে নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন অনুশোচনা আর বিচ্ছেদের আগুনে দগ্ধ হওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করা থাকে না। সাজুর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সে নিরুদ্দেশ হয়।
কিন্তু রূপাইকে একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না সাজু। প্রতিটি মুহূর্ত বুকের ভেতর প্রেমের অগ্নিশিখা জ্বলতে থাকে। রূপাইয়ের ফেরার অপেক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে সে দগ্ধ হতে থাকে। এক সময় সবাই ফিরলেও রূপাই ফেরে না। সাজুর দেহমন জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যায়। জীবনপ্রদীপ আস্তে আস্তে নিভে আসতে থাকে। খুঁজতে থাকে নিজের অপরাধ। কোন্ অপরাধে তার এ শাস্তি! সাজুর কান্না শুধু পরিবার নয় আশাপাশের সমস্ত মানুষকে ব্যথিত করে। প্রকৃতিও যেন সে কান্নায় একাত্ম হয়ে ওঠে।
জীর্ণ-শীর্ণ শরীরে সাজু নকশিকাঁথায় নিজেদের জীবনের নানা স্মৃতিচিত্র আঁকে। একই সঙ্গে মায়ের কাছে আবেদন জানায়- মারা গেলে এই নক্শিকাঁথাটি যেন তার কবরের গায়ে মেলে দেয়া হয়। সাজুর মৃত্যুতে এ কাব্যে যে বেদনার্ত পরিবেশ তৈরি হয় তা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় তার মায়ের গগণবিদারী আর্তনাদ ও আহাজারি। রূপাই যে ভুল করেছিল এর চরম মূল্য শুধু সাজু কিংবা সাজুর মা-ই দেননি, রূপাই নিজেও দিয়েছে। সে-ও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। তারও মৃত্যুও ঘটেছে। তার মৃত্যুর ভেতর দিয়েই ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ সার্থক ট্রাজেডি গুণসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।
এ কাব্যে রূপাইয়ের ভুল থেকেই ট্রাজেডির বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। সেই বীজ রূপাই থেকে সাজু, সাজু থেকে তার বৃদ্ধা মা-এ সংক্রমিত হয়ে পরিপূর্ণ এক ট্রাজেডি রূপ ধারণ করে। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ও আমরা দেখেছি সব বিষাদের মূলে রাবণ।
মেঘনাদবধের ট্রাজেডি রাবণের ট্রাজেডি হয়ে উঠেছে। ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ কাব্যেও রূপাইয়ের ভুল ট্রাজেডি হয়ে উঠেছে রূপাইয়ের নিজের জীবনে, তার স্ত্রী সাজু ও সাজুর বৃদ্ধা মায়ের জীবনে। যা একটি ভুল থেকেই সংক্রমিত। জসীম উদ্দীন ট্রাজিক রূপায়ণে ‘নক্শিকাঁথার মাঠে’ সার্থকতা দেখিয়েছেন।
জসীম উদ্দীন তার ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যে সচেতনভাবে ট্রাজেডির আবহ নির্মাণ করেছেন। এ কাব্যের স্থান-কাল-পাত্র-চলন-বলন-কথন একেবারেই গ্রামীণজীবন স্নাত। যেখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই, বাড়তি কোনো রঙ-ঢঙ নেই, যা তাই শিল্পের মহিমায় উদ্ভাসিত। এ কাব্যের চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে যাওয়া যায়, বুক ভরে শান্তি করে নিঃশ্বাস নেয়া যায়, আবার বুক খুলে মন ভরে কাঁদাও যায়।
নিখাঁদ মাটির গন্ধভরা তার কাব্য। যা খুব সহজেই দখল করে নিতে পেরেছে পাঠকসাম্রাজের হৃদয়। যে কারণে ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যের আবেদন বাঙালি-পাঠকের কাছে চিরন্তন। এ যেন বাঙালি হৃদয়ের সুতো দিয়ে গাঁথা-শিরাধমনিতে নিত্য প্রবাহিত। আর সে কারণেই ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ শুধু পল্লী-প্রকৃতির মানুষের নয়, সমগ্র বাঙালিরই যেন জীবনকাব্য হয়ে উঠেছে।
নাগরিক ডেস্ক: ধর্মঘটের মাঝে ঘটা করে টেলিকম কোম্পানি গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তি করেন সাকিব আল হাসান। দেশের শীর্ষস্থানীয় টেলিকম কোম্পানির সঙ্গে এই চুক্তি বিসিবির নিয়মবহির্ভূত বলে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড(বিসিবি)।
ক্রিকেটারদের সঙ্গে বিসিবি’র চুক্তি অনুসারে, একজন জাতীয় দলের খেলোয়াড় কোনো টেলিকম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে পারবেন না। আজ দেশের এক দৈনিকে বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন বলেন, ‘ সে(সাকিব) কোনো টেলিকম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে পারেনা। এবং কেন পারেনা তা আমাদের চুক্তিপত্রে লেখা আছে।’ মূলত এর আগে এমন চুক্তির ফলে বোর্ড আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। বিসিবি প্রধান সেই প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘রবি(টেলিকম কোম্পানি) আমাদের টাইটেল স্পন্সর ছিল। এর মাঝে গ্রামীণফোন বিড না করে কয়েকজন খেলোয়াড়কে বাগিয়ে নেয় তাও মাত্র এক বা দুই কোটি টাকার বিনিময়ে। এতে কি হলো? তিন বছরে বোর্ড ৯০ কোটি টাকা হারালো। কয়েকজন খেলোয়াড়ের লাভের জন্য বোর্ড ভুগবে তা হতে পারেনা।
আতিকুর রহমান নগরী
প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব
আজকের এই পৃথিবীতে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় দেড়শ’ কোটির মতো। আজ পৃথিবীর অন্যান্য জাতিবর্গ সভ্যতার পোশাকধারী, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান যাদের হাতে লালিত পালিত হচ্ছে। তারাই এসবের দাবিদার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ একথা কেউ আর ভাবে না যে, এ সভ্যতা কোথা থেকে এলো? জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্বেষণ ও এর অনুসরণ-অনুকরণ, অনুধাবন মুসলমানদের ঈমানেরই অঙ্গ ও অংশবিশেষ। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে শিক্ষা-দীক্ষার জন্য নানারূপ উপদেশ বাণী রয়েছে। তদ্রুপ হাদীস শরীফেও বিভিন্ন উৎসাহ বাণী আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, মুসলমানদের ধর্মীয় প্রেরণা ও প্রয়োজন তাদেরকে জ্ঞানার্জনে বাধ্য করেছে। অবশ্য, অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার দুর্নিবার আগ্রহ এর মূলে রয়েছে। মধ্য যুগে তারাই বিশ্ববাসীকে বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের সূত্রপাত তারাই করেছেন। পিকে. হিট্টির ভাষায় বলতে হয়, ‘অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত কোরআন ও হাদীসধারীগণ সমগ্র বিশ্বে সভ্যতা সংস্কৃতিকে আলাদা করেছেন।’
ইতিহাস হচ্ছে একটি জাতির দর্পণ। তারই মধ্যে পূর্বের আলোকে, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ চিত্র সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়। হিজরী দ্বিতীয় সনে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস রচনার প্রকৃত ভিত্তি গড়ে উঠে। আলী বিন মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ মাদায়েনী ছিলেন ইসলামের প্রথম ইতিহাস লেখক। সমগ্র বিশ্বের সর্বশেষ ঐতিহাসিক হচ্ছেন পারস্যের তাবারী স্থানের অধিকারী আবু জাফর মোহাম্মদ ইবনে জারীর আত্-তারাবী। যিনি দৈনিক ৪০ পৃষ্ঠা করে সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর্যন্ত ইতিহাস লিখার কাজে ব্যয় করেছিলেন। তাছাড়া ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক, ইবনে সা’দ, আল-ওয়াকিদি, আল-মাসুদী ও ইবনে খালদুন হলেন বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিকদের অন্যতম। মুসলিম দর্শন হযরত আদম (আ.)-এর কাল থেকেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। জীবন ও জগতের পরিপূর্ণ মূল্যায়নের নাম যদি দর্শন হয়, তবে কি হযরত ইব্রাহিম (আ.) তথা অন্যান্য নবীর খোদা লাভের ধ্যান-ধারণা দর্শন নয়? কিন্তু বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইবনেসিনা, ইবনে রুশদ ও ইমাম গাজ্জালীর যুগে দর্শন শাস্ত্রের প্রকৃত চেহারা ফুটে উঠে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বিশ্ববাসী বুঝতে সক্ষম হয়েছে, মুসলিম দর্শনই প্রকৃত দর্শন। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক হলেন আল-ফারাবী ও ইমাম গাজ্জালী। পবিত্র কোরআনে রোগ যন্ত্রণার মুক্তির পথ বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে সহীহ বোখারী শরীফে এ সম্পর্কে দুটি অধ্যায়ের অবতারণা করা হয়েছে। এ শাস্ত্র যাদের ছোঁয়ায় ভরপুর তারা হলেন- হুমায়ুন বিন ইসহাক, ইসা বিন ইয়াহিয়া, জাবির বিন হাইয়ান, মোহাম্মদ বিন জাকারিয়া, আলী, রাজীত, ইবনে সিনা, ইবনে মিনার। ‘কানুন’ নামক গ্রন্থ পাশ্চাত্যে ‘মেডিকেল বাইবেল’ নামে পরিচিত হয়েছিল। সুদীর্ঘ আটশ’ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক রূপে নির্ধারিত ছিল। বর্তমানে প্রচলিত অঙ্ক শাস্ত্রের জনক হলেন ‘আল খারিজমী’। তার রচিত গ্রন্থ দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত আধুনিক সভ্যতাভিমানী ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ল্যাটিন অনুবাদের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়েছিল। তাছাড়া নব্য রসায়ন শাস্ত্র যাকে আমরা কেমিস্ট্রি বলে থাকি এর আবিষ্কারক হলেন ‘জাবির বিন হাইয়ান’। ইউরোপের বীজগণিতে নব যুগের সূচনাকারী হলেন ‘ঈসা আল মুহানী’ প্রকৃত পক্ষে মুসলিম মানচিত্রকার ও ভূগোলবিদ হলেন- আল খারিজমী, আলী ইদ্রিস, আল মাকসুদী, আল বেরুনী প্রমুখ।
এরূপভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় মুসলিম মনীষীদের অবদান অন্ধকার আকাশে পূর্ণিমার চন্দ্রের মতো বিরাজমান। মানব সমাজের প্রধান প্রধান কাজ মুসলমানগণ সমাধান করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক আল ফারাবী ছিলেন মুসলমান। সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবেত্তা আবু কামিল ও ইব্রাহিম বিন সিনান ছিলেন মুসলমান। সর্বশ্রেষ্ঠ মানচিত্রকার ও ভূগোলবিদ আলী ইদ্রিস, আল মাকসুদী ছিলেন মুসলমান। বর্তমান বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক মুসলমানদের নিকট শতদিক দিয়ে ঋণী। কিন্তু হায়! যখন ইউরোপবাসীরা দস্তখত তো দূরের কথা দু’হাতের সাহায্যে টিপসইও দিতে জানতো না, তখন মুসলিম স্পেনে একজন নিরক্ষর লোক পাওয়া যেত না। আজ মুসলিম সমাজ তাদের মূল পুঁজি কোরআন-হাদীসকে অবহেলা করে বিশ্ববাসীর হাসির খোরাক ও হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। নানারূপ নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়গুলো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভালোভাবে কোরআন-হাদীস বুঝার ও নবীর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে সুন্দর জীবন যাপন করার তৌফিক দান করেন। আমিন!