ড. রকিবুল হাসান: রবীন্দ -নজরুলের পরে এখনও জসীম উদ্দীনের নামই অবধারিতভাবে চলে আসে। এই ক্রমধারা থেকেই অনুধাবন করা যায় বাংলা কবিতায় জসীম উদ্দীনের অবদান ও অবস্থান। পল্লীকেন্দ্রিক যাপিতজীবন ও প্রকৃতিকে কবিতায় উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে জসীম উদ্দীনের পূর্বসূরি রয়েছেন আরও অনেকেই। তিনি নিজস্ব প্রতিভাবৈচিত্র্য ও সক্রিয়তায় পল্লী কবিতার এ ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন বহুগুণে।
প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর :২৬ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
করুণানিধানের এ ধারা বা ভাবনাটি আরও অনেকখানি এগিয়ে নেন যতীন্দ মোহন বাগচী। পল্লীর দৈনন্দিন জীবনযাপন তাকে অনেকটা গভীরভাবেই স্পর্শ করে। যে কারণে যতীন্দ মোহন রবীন্দ ভাবনায় লালিত হয়েও তার কাব্যে পল্লীজীবন বৈচিত্র্যকে কাব্যে উপজীব্য করেছেন। যতীন্দ মোহনের কবিতায় পল্লীর বহুমাত্রিকতা সন্নিবদ্ধ না থাকলেও, পল্লী-প্রকৃতিকে কবিতায় পরীক্ষা-নীরিক্ষার প্রয়াস লক্ষ করা না গেলেও, তার কবিতায় পল্লীর নিবিড় ও সৌম্য-শান্ত যে রূপটি ধরা পড়েছে তা কাব্যের এ নবধারায় গুরুত্বপূর্ণ।
এ নদীর কথা তার কবিতায় বহুভাবে বহু রঙে ব্যঞ্জিত হয়েছে। এ নদীর সঙ্গে তার জন্মান্তরের সৌহার্দ্য- কবি তা নিজেই স্বীকার করেছেন। পল্লীর মাঠ-ঘাট, বনস্পতি ফল, ছায়াতরু, তৃণগুল্ম, মেঘলা আকাশ, ভোরের আকাশ, গ্রামের পাখি, হাওর-বিল-নদী-নালা পরম মমতায় তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন।
পল্লী যেন নিজস্ব স্বরূপে এই প্রথম কবিতারাজ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ এক রূপে সেও যে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতে পারে- কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কবিতায় সেই সত্য বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
চূড়ান্ত সিদ্ধি অর্জনে তিনি সক্ষম না হলেও এ ধারাকে সমৃদ্ধতর করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অসামান্য ছিল। এ ধারারই সবচেয়ে সফল কবিপুরুষ জসীম উদ্দীন। পল্লী-প্রকৃতি আর যাপিতজীবনকে তিনি ভোরের ঘাসে শিশির ফোটার মতো কবিতায় অসামান্য দক্ষতায় ‘টলমল’ জীবন্ত করে তুললেন।
এতদিনে করুণানিধান, যতীন্দ্রমোহন ও কুমুদরঞ্জনেরা পল্লী-প্রকৃতিকে কবিতায় উপজীব্য করে যে নবধারার যাত্রা রচনা করেছিলেন, জসীম উদ্দীনের হাতে পেল তার উজ্জ্বল পূর্ণতা। জসীম উদ্দীনের সমকালীন সময়ে বন্দে আলী মিয়া ও কাজী কাদের নওয়াজ পল্লী জীবনপ্রকৃতি নিয়ে কাব্যচর্চায় সফলতা লাভ করলেও জসীম উদ্দীন হয়ে ওঠেন সমকালীন কবিদের মধ্যমণি। পাঠকমহলে লাভ করেন অবিশ্বাস্যরকমের জনপ্রিয়তা।
সমকালীন কবিদের মধ্যে নজরুলের পরে আর কেউই জসীম উদ্দীনের মতো জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেননি। এমনকি পরবর্তীতেও আর কোনো কবি তার জনপ্রিয়তাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হননি। জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় বিখ্যাত কবি। পল্লী-প্রকৃতির রূপমাধুর্য তিনি অসাধারণ শিল্পশৈলীতে তুলে ধরে বাংলা কবিতায় অসম্ভবরকম জনপ্রিয়তা লাভা করেছেন।
তারপরও জসীম উদ্দীন যেভাবে ঘাট-মাঠের মানুষের কবি, জীবনানন্দ দাশ সেখান থেকে খানিকটা দূরেই। জীবনানন্দ দাশ যতখানি পল্লী-প্রকৃতির কবি, পল্লীর মানুষের ততখানি নন। পল্লী-নগরসভ্যতা-ইতিহাস-ঐতিহ্য সবমিলে জীবনানন্দের জগৎ ভিন্ন।
জসীম উদ্দীনের পরেও আর একজন বাঙালি কবি পল্লী-প্রকৃতি ও পল্লীর মানুষকে নিয়েই জীবনভর কবিতা লিখেছেন, তিনি ওমর আলী। একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কবি হলেও, ব্যাপক জনপ্রিয়- সে অভিধা তিনি লাভ করতে পারেননি।
জসীম উদ্দীনের এ রকম জনপ্রিয়তা লাভের মূল কারণ কী ছিল- সে বিষয় ভাবা যেতেই পারে। পল্লীর সহজ-সরল জীবনগাথাই তার কাব্যে পাঠকপ্রিয়তা লাভে মূল কারণ- এ প্রশ্নও খুব স্বাভাবিক। পল্লীর এ সহজ-সরল জীবনগাথা তো অন্য কবিরাও তাদের কাব্যে উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে ছিলেন। কিন্তু তারা জসীম উদ্দীনের মতো কবিখ্যাতি ও পাঠকপ্রিয়তা লাভে সক্ষম হননি।
তিনি পল্লীর জীবনগাথাকে যেভাবে জীবন্ত করে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, সমাজচিত্রকে যে নিপুণতায় এঁকেছেন, গ্রামীণ মানুষের মনস্বত্বঃ যেভাবে তিনি ধরেছেন, তাদের মানবসম্পর্ক ও প্রেমকে যে ট্রাজিক রূপদান করেছেন, সর্বোপরি সামগ্রিক বিষয়কে শিল্পগুণ সমৃদ্ধ করে অসাধারণ ভাষাভঙ্গিমায় কাব্যরূপ দান করেছেন- তা পাঠকপ্রিয়তা লাভে বড় শক্তি।
নজরুল পরাধীন দেশের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে অগ্নিবীণা বাজিয়েছিলেন, বিষের বাঁশিতে সর্বনাশার সুর জাগরিত করেছিলেন, মহাসমুদ্রের তুফান কবিতায় এনেছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মহামন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, এ সব তাঁর আকাশ-স্পর্শী জনপ্রিয়তা অর্জনের মূল কারণ। জসীম উদ্দীন নজরুলের এ ধারায় একটুও না গিয়ে পল্লীর সাধারণ মানুষের আনন্দ-বেদনাকে কাব্যে ধারণ করে পাঠকের হৃদয় জয় করেন। তাঁর কবিতার করুণ রস বা ট্রাজেডিই পাঠকপ্রিয়তা লাভে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে -এমন বিবেচনা নানাকৌণিক থেকেই নির্ণীত হতে পারে।
জসীম উদ্দীনের কাহিনী কাব্য চারটি : ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘সকিনা, ও ‘মা যে জননী কান্দে’। এ চারটি কাব্যেই ট্রাজেডি রস সঞ্চারে কবি সফলতার পরিচয় রেখেছেন।
‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্য দুটিতে শেকসপিরিয়ান ট্রাজেডি রূপবৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে। কর্মের ফলই যে মানুষ ভোগ করে এ দুটো কাব্যে শেকসপীয়রের নাটকের ট্রাজেডির মতোই একই সত্যরূপ লক্ষণীয়। এখানে আলোচনা ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ দেখা যায়, কাব্যে রূপাই ও সাজু বিয়ে করে সুখের সংসার বেঁধেছিল।
বন গেঁয়োরা যখন গাজনা চরের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছিল, সে খবর পেয়েই রূপাই সড়কি-ঢাল নিয়ে গাজনাচরে কাইজা করার জন্য ছুটে যায় এবং নেতৃত্ব দেয়। রূপাই ইচ্ছে করলে এই কাইজা সে এড়াতে পারত। কিন্তু কাইজা শেষে যখন সে নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন অনুশোচনা আর বিচ্ছেদের আগুনে দগ্ধ হওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করা থাকে না। সাজুর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সে নিরুদ্দেশ হয়।
কিন্তু রূপাইকে একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না সাজু। প্রতিটি মুহূর্ত বুকের ভেতর প্রেমের অগ্নিশিখা জ্বলতে থাকে। রূপাইয়ের ফেরার অপেক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে সে দগ্ধ হতে থাকে। এক সময় সবাই ফিরলেও রূপাই ফেরে না। সাজুর দেহমন জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যায়। জীবনপ্রদীপ আস্তে আস্তে নিভে আসতে থাকে। খুঁজতে থাকে নিজের অপরাধ। কোন্ অপরাধে তার এ শাস্তি! সাজুর কান্না শুধু পরিবার নয় আশাপাশের সমস্ত মানুষকে ব্যথিত করে। প্রকৃতিও যেন সে কান্নায় একাত্ম হয়ে ওঠে।
জীর্ণ-শীর্ণ শরীরে সাজু নকশিকাঁথায় নিজেদের জীবনের নানা স্মৃতিচিত্র আঁকে। একই সঙ্গে মায়ের কাছে আবেদন জানায়- মারা গেলে এই নক্শিকাঁথাটি যেন তার কবরের গায়ে মেলে দেয়া হয়। সাজুর মৃত্যুতে এ কাব্যে যে বেদনার্ত পরিবেশ তৈরি হয় তা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় তার মায়ের গগণবিদারী আর্তনাদ ও আহাজারি। রূপাই যে ভুল করেছিল এর চরম মূল্য শুধু সাজু কিংবা সাজুর মা-ই দেননি, রূপাই নিজেও দিয়েছে। সে-ও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। তারও মৃত্যুও ঘটেছে। তার মৃত্যুর ভেতর দিয়েই ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ সার্থক ট্রাজেডি গুণসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।
এ কাব্যে রূপাইয়ের ভুল থেকেই ট্রাজেডির বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। সেই বীজ রূপাই থেকে সাজু, সাজু থেকে তার বৃদ্ধা মা-এ সংক্রমিত হয়ে পরিপূর্ণ এক ট্রাজেডি রূপ ধারণ করে। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ও আমরা দেখেছি সব বিষাদের মূলে রাবণ।
মেঘনাদবধের ট্রাজেডি রাবণের ট্রাজেডি হয়ে উঠেছে। ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ কাব্যেও রূপাইয়ের ভুল ট্রাজেডি হয়ে উঠেছে রূপাইয়ের নিজের জীবনে, তার স্ত্রী সাজু ও সাজুর বৃদ্ধা মায়ের জীবনে। যা একটি ভুল থেকেই সংক্রমিত। জসীম উদ্দীন ট্রাজিক রূপায়ণে ‘নক্শিকাঁথার মাঠে’ সার্থকতা দেখিয়েছেন।
জসীম উদ্দীন তার ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যে সচেতনভাবে ট্রাজেডির আবহ নির্মাণ করেছেন। এ কাব্যের স্থান-কাল-পাত্র-চলন-বলন-কথন একেবারেই গ্রামীণজীবন স্নাত। যেখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই, বাড়তি কোনো রঙ-ঢঙ নেই, যা তাই শিল্পের মহিমায় উদ্ভাসিত। এ কাব্যের চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে যাওয়া যায়, বুক ভরে শান্তি করে নিঃশ্বাস নেয়া যায়, আবার বুক খুলে মন ভরে কাঁদাও যায়।
নিখাঁদ মাটির গন্ধভরা তার কাব্য। যা খুব সহজেই দখল করে নিতে পেরেছে পাঠকসাম্রাজের হৃদয়। যে কারণে ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যের আবেদন বাঙালি-পাঠকের কাছে চিরন্তন। এ যেন বাঙালি হৃদয়ের সুতো দিয়ে গাঁথা-শিরাধমনিতে নিত্য প্রবাহিত। আর সে কারণেই ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ শুধু পল্লী-প্রকৃতির মানুষের নয়, সমগ্র বাঙালিরই যেন জীবনকাব্য হয়ে উঠেছে।
সাহিত্য পত্রিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রিকা। পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৬৪ বঙ্গাব্দের (১৯৫৭) আষাঢ় মাসে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং এ দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত গবেষণামুলক প্রবন্ধ প্রকাশের উদ্দেশ্যেই মূলত পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়।
সাহিত্য পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাই। তিনি একাদিক্রমে বারো বছর এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পত্রিকাটির মান ও জনপ্রিয়তা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেন। পরে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিভাগীয় শিক্ষকগণ এ দায়িত্ব পালন করেছেন। শুরু থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি শীত ও বর্ষা সংখ্যা হিসেবে বছরে দুবার প্রকাশিত হতো। পরের বছর থেকে আষাঢ়, কার্তিক ও ফাল্গুন সংখ্যা হিসেবে বছরে তিনটি করে প্রকাশিত হতে থাকে।
প্রকাশের শুরু থেকেই পত্রিকাটি বাংলাভাষী পন্ডিত ও সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এতে দেশি-বিদেশী সাহিত্য, তুলনামূলক সমালোচনা, লোকসংস্কৃতি, সাহিত্যতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্বব, অভিধান, লিপিতত্ত্ব, সাময়িকপত্র, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
আতিকুর রহমান নগরী
প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব
আজকের এই পৃথিবীতে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় দেড়শ’ কোটির মতো। আজ পৃথিবীর অন্যান্য জাতিবর্গ সভ্যতার পোশাকধারী, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান যাদের হাতে লালিত পালিত হচ্ছে। তারাই এসবের দাবিদার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ একথা কেউ আর ভাবে না যে, এ সভ্যতা কোথা থেকে এলো? জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্বেষণ ও এর অনুসরণ-অনুকরণ, অনুধাবন মুসলমানদের ঈমানেরই অঙ্গ ও অংশবিশেষ। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে শিক্ষা-দীক্ষার জন্য নানারূপ উপদেশ বাণী রয়েছে। তদ্রুপ হাদীস শরীফেও বিভিন্ন উৎসাহ বাণী আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, মুসলমানদের ধর্মীয় প্রেরণা ও প্রয়োজন তাদেরকে জ্ঞানার্জনে বাধ্য করেছে। অবশ্য, অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার দুর্নিবার আগ্রহ এর মূলে রয়েছে। মধ্য যুগে তারাই বিশ্ববাসীকে বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের সূত্রপাত তারাই করেছেন। পিকে. হিট্টির ভাষায় বলতে হয়, ‘অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত কোরআন ও হাদীসধারীগণ সমগ্র বিশ্বে সভ্যতা সংস্কৃতিকে আলাদা করেছেন।’
ইতিহাস হচ্ছে একটি জাতির দর্পণ। তারই মধ্যে পূর্বের আলোকে, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ চিত্র সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়। হিজরী দ্বিতীয় সনে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস রচনার প্রকৃত ভিত্তি গড়ে উঠে। আলী বিন মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ মাদায়েনী ছিলেন ইসলামের প্রথম ইতিহাস লেখক। সমগ্র বিশ্বের সর্বশেষ ঐতিহাসিক হচ্ছেন পারস্যের তাবারী স্থানের অধিকারী আবু জাফর মোহাম্মদ ইবনে জারীর আত্-তারাবী। যিনি দৈনিক ৪০ পৃষ্ঠা করে সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর্যন্ত ইতিহাস লিখার কাজে ব্যয় করেছিলেন। তাছাড়া ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক, ইবনে সা’দ, আল-ওয়াকিদি, আল-মাসুদী ও ইবনে খালদুন হলেন বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিকদের অন্যতম। মুসলিম দর্শন হযরত আদম (আ.)-এর কাল থেকেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। জীবন ও জগতের পরিপূর্ণ মূল্যায়নের নাম যদি দর্শন হয়, তবে কি হযরত ইব্রাহিম (আ.) তথা অন্যান্য নবীর খোদা লাভের ধ্যান-ধারণা দর্শন নয়? কিন্তু বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইবনেসিনা, ইবনে রুশদ ও ইমাম গাজ্জালীর যুগে দর্শন শাস্ত্রের প্রকৃত চেহারা ফুটে উঠে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বিশ্ববাসী বুঝতে সক্ষম হয়েছে, মুসলিম দর্শনই প্রকৃত দর্শন। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক হলেন আল-ফারাবী ও ইমাম গাজ্জালী। পবিত্র কোরআনে রোগ যন্ত্রণার মুক্তির পথ বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে সহীহ বোখারী শরীফে এ সম্পর্কে দুটি অধ্যায়ের অবতারণা করা হয়েছে। এ শাস্ত্র যাদের ছোঁয়ায় ভরপুর তারা হলেন- হুমায়ুন বিন ইসহাক, ইসা বিন ইয়াহিয়া, জাবির বিন হাইয়ান, মোহাম্মদ বিন জাকারিয়া, আলী, রাজীত, ইবনে সিনা, ইবনে মিনার। ‘কানুন’ নামক গ্রন্থ পাশ্চাত্যে ‘মেডিকেল বাইবেল’ নামে পরিচিত হয়েছিল। সুদীর্ঘ আটশ’ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক রূপে নির্ধারিত ছিল। বর্তমানে প্রচলিত অঙ্ক শাস্ত্রের জনক হলেন ‘আল খারিজমী’। তার রচিত গ্রন্থ দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত আধুনিক সভ্যতাভিমানী ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ল্যাটিন অনুবাদের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়েছিল। তাছাড়া নব্য রসায়ন শাস্ত্র যাকে আমরা কেমিস্ট্রি বলে থাকি এর আবিষ্কারক হলেন ‘জাবির বিন হাইয়ান’। ইউরোপের বীজগণিতে নব যুগের সূচনাকারী হলেন ‘ঈসা আল মুহানী’ প্রকৃত পক্ষে মুসলিম মানচিত্রকার ও ভূগোলবিদ হলেন- আল খারিজমী, আলী ইদ্রিস, আল মাকসুদী, আল বেরুনী প্রমুখ।
এরূপভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় মুসলিম মনীষীদের অবদান অন্ধকার আকাশে পূর্ণিমার চন্দ্রের মতো বিরাজমান। মানব সমাজের প্রধান প্রধান কাজ মুসলমানগণ সমাধান করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক আল ফারাবী ছিলেন মুসলমান। সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবেত্তা আবু কামিল ও ইব্রাহিম বিন সিনান ছিলেন মুসলমান। সর্বশ্রেষ্ঠ মানচিত্রকার ও ভূগোলবিদ আলী ইদ্রিস, আল মাকসুদী ছিলেন মুসলমান। বর্তমান বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক মুসলমানদের নিকট শতদিক দিয়ে ঋণী। কিন্তু হায়! যখন ইউরোপবাসীরা দস্তখত তো দূরের কথা দু’হাতের সাহায্যে টিপসইও দিতে জানতো না, তখন মুসলিম স্পেনে একজন নিরক্ষর লোক পাওয়া যেত না। আজ মুসলিম সমাজ তাদের মূল পুঁজি কোরআন-হাদীসকে অবহেলা করে বিশ্ববাসীর হাসির খোরাক ও হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। নানারূপ নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়গুলো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভালোভাবে কোরআন-হাদীস বুঝার ও নবীর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে সুন্দর জীবন যাপন করার তৌফিক দান করেন। আমিন!